মলদ্বার চুলকানি (Pruritus Ani) একটি খুবই সাধারণ এবং বিব্রতকর সমস্যা। নিচে এর কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা এবং পরামর্শ বিস্তারিতভাবে দেওয়া হলো:
কারণসমূহ (Causes)
মলদ্বার চুলকানির পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, সেগুলোকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়:
স্বাস্থ্যবিধি ও অভ্যাসজনিত কারণ:
১. অপর্যাপ্ত পরিচ্ছন্নতা: মলত্যাগের পর মলদ্বার ভালোভাবে পরিষ্কার না করলে, মল লেগে থেকে ফলে জ্বালা ও সংক্রমণের সৃষ্টি হয়।
২. অতিরিক্ত পরিচ্ছন্নতা ও ঘষা: বেশি ঘষে পরিষ্কার করা, শক্ত বা সুগন্ধিযুক্ত (কেমিক্যালযুক্ত) টয়লেট পেপার (টিস্যু), বা সাবান ব্যবহার করা যা, ত্বকের ক্ষতি করে চুলকানি বাড়াতে পারে।
৩. আর্দ্রতা: পায়ুপথ অঞ্চলে অতিরিক্ত ঘাম বা মলদ্বারে আর্দ্রতা (যেমন ডায়রিয়া বা দুর্বল পেশির কারণে মল বা শ্লেষ্মার সামান্য নিঃসরণ) ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধি ঘটাতে পারে।
৪. পোশাক: আঁটসাঁট বা সিনথেটিক অন্তর্বাস পরা।
স্বাস্থ্যগত বা চিকিৎসা সংক্রান্ত কারণ:
১. পাইলস (Hemorrhoids) বা ফিশার (Anal Fissure): মলদ্বার বা মলাশয়ের এসব রোগ চুলকানির একটি বড় কারণ।
২. ত্বকের সমস্যা: একজিমা, সোরিয়াসিস বা কন্ট্যাক্ট ডার্মাটাইটিসের (সাবান, ডিটারজেন্ট, ক্রিম থেকে অ্যালার্জি) মতো চর্মরোগ।
সংক্রমণ:
১. ছত্রাক সংক্রমণ (Fungal infection): বিশেষ করে উষ্ণ ও আর্দ্র পরিবেশে।
২. কৃমি (worms): বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে।
৩. ব্যাকটেরিয়াজনিত বা যৌনবাহিত সংক্রমণ (STI)।
৪. খাদ্যাভ্যাস: কফি, চা, কোলা, মদ, বিয়ার, চকোলেট, বেগুন, বাদাম, দুধ, দুগ্ধজাত খাবার এবং অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার অনেকের ক্ষেত্রে চুলকানি বাড়াতে পারে।
৫. অন্যান্য রোগ: ডায়াবেটিস বা থাইরয়েডের মতো কিছু স্বাস্থ্যগত অবস্থা।
৬. ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: কিছু অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ সেবন।
লক্ষণসমূহ (Symptoms)
প্রধান এবং সুস্পষ্ট লক্ষণ হলো মলদ্বার বা তার আশেপাশে তীব্র চুলকানি। এর সাথে নিম্নোক্ত লক্ষণগুলি থাকতে পারে:
১. জ্বালা বা ব্যথা: চুলকানোর পরে বা মলত্যাগের সময় জ্বালা অনুভব করা।
২. ফোলা বা লালচে ভাব: ক্রমাগত চুলকানোর ফলে ত্বক লাল হয়ে যেতে পারে বা ফুলে উঠতে পারে।
৩. ঘা বা ত্বকের ক্ষতি: অতিরিক্ত চুলকানোর ফলে ত্বক ফেটে যাওয়া বা ক্ষত সৃষ্টি হওয়া।
৪. ভেজা বা আর্দ্রতা: অনেক সময় মলদ্বার ভেজা ভেজা লাগতে পারে।
৫. রাতের বেলা বৃদ্ধি: ঘুমের সময় চুলকানির তীব্রতা বেড়ে যাওয়া।
চিকিৎসা (Treatment)
মলদ্বার চুলকানির চিকিৎসা নির্ভর করে এর সঠিক কারণের ওপর। চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হলো চুলকানি কমানো এবং ত্বকের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা।
কারণ দূর করা: যদি পাইলস, কৃমি বা ছত্রাক সংক্রমণের মতো কোনো নির্দিষ্ট কারণ চিহ্নিত হয়, তবে সেই নির্দিষ্ট রোগের চিকিৎসা করতে হবে।
টপিক্যাল ক্রিম ও মলম:
১. স্টেরয়েড ক্রিম: চুলকানি এবং প্রদাহ কমাতে স্বল্প সময়ের জন্য (১-২ সপ্তাহ) ১% হাইড্রোকর্টিসন জাতীয় ক্রিম ব্যবহার করা যেতে পারে (অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী)।
২. জিঙ্ক অক্সাইড বা পেট্রোলিয়াম জেলি: মলদ্বারের ত্বককে আর্দ্রতা থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
মুখে সেবনের ওষুধ:
১. অ্যান্টিহিস্টামিন: রাতে চুলকানি কমাতে এবং ঘুম ভালো হওয়ার জন্য অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ দিতে পারেন।
২. সংক্রমণের ওষুধ: যদি ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক সংক্রমণ থাকে, তবে অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধ সেবন করতে হতে পারে।
৩. অন্যান্য পদ্ধতি: দীর্ঘস্থায়ী এবং তীব্র চুলকানির ক্ষেত্রে ইনজেকশন বা প্রয়োজনে সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে সেইক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
পরামর্শ ও প্রতিরোধ (Advice and Prevention)
চুলকানি থেকে মুক্তি পেতে এবং ভবিষ্যতে প্রতিরোধ করতে কিছু অভ্যাস পরিবর্তন করা অত্যন্ত জরুরি:
সঠিক পরিচ্ছন্নতা:
১. আলতোভাবে পরিষ্কার করুন: মলত্যাগের পর শুধুমাত্র জল বা নরম ভেজা তুলো/কাপড় দিয়ে আলতোভাবে পরিষ্কার করুন।
২. সাবান পরিহার করুন: মলদ্বারে সুগন্ধিযুক্ত সাবান, ডিওডোরেন্ট বা অন্যান্য রাসায়নিক ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
৩. ঘষা নয়, চেপে শুকনো করুন: পরিষ্কার করার পর ঘষা বা মোছা এড়িয়ে চলুন। নরম তোয়ালে বা টিস্যু দিয়ে আলতোভাবে চেপে চেপে বা হেয়ার ড্রায়ার ফ্যানের কম সেটিং ব্যবহার করে শুকিয়ে নিন।
৪. আর্দ্রতা শোষণ: দিনের বেলা মলদ্বার শুকনো রাখতে সামান্য পরিমাণে সাধারণ কর্নস্টার্চ পাউডার বা এক টুকরো নরম তুলো ব্যবহার করতে পারেন।
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন:
১. উপরে উল্লেখিত চুলকানি সৃষ্টিকারী খাবার ও পানীয় (যেমন: কফি, চা, চকোলেট, মসলাযুক্ত খাবার, অ্যালকোহল, বেগুন) সাময়িকভাবে খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিন।
২. পর্যাপ্ত আঁশযুক্ত খাবার (ফল, সবজি, আস্ত শস্যদানা) খান এবং পর্যাপ্ত পানি পান করুন। এটি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে এবং নিয়মিত মলত্যাগে সহায়তা করে।
জীবনযাত্রার পরিবর্তন:
১. চুলকানো এড়িয়ে চলুন: চুলকানির তীব্র ইচ্ছা হলে নখ ছোট রাখুন এবং রাতে ঘুমানোর সময় সুতির গ্লাভস ব্যবহার করতে পারেন।
২. পোশাক: সুতির, ঢিলেঢালা অন্তর্বাস পরিধান করুন এবং ঘন ঘন পরিবর্তন করুন। আঁটসাঁট প্যান্ট বা জিন্স এড়িয়ে চলুন।
৩. ঔষধের ব্যবহার: চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া চুলকানির জন্য ওভার-দ্য-কাউন্টার ক্রিম বা মলম দীর্ঘদিন ব্যবহার করবেন না, কারণ এতে থাকা উপাদান অনেক সময় সমস্যা আরও বাড়াতে পারে।
গুরুত্বপূর্ণ নোট: যদি চুলকানি তীব্র, দীর্ঘস্থায়ী হয়, মলদ্বার থেকে রক্তপাত হয়, মল বা শ্লেষ্মা নিঃসরণ হয়, অথবা সংক্রমণ হয়েছে বলে মনে হয়, তবে অবশ্যই একজন কোলোরেক্টাল সার্জন বা চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের (Dermatologist) পরামর্শ নিন। সঠিক রোগ নির্ণয় এবং কারণভিত্তিক চিকিৎসা এই সমস্যা থেকে দ্রুত মুক্তি দিতে পারে।
